২৭ এপ্রিল ২০১২, শনিবার, ০৮:১৭:২০ অপরাহ্ন
শিরোনাম :
‘ব্রাজিল থেকে জীবন্ত গরু আনা সম্ভব, তবে প্রক্রিয়া জটিল’ খালেদা জিয়ার সঙ্গে মির্জা ফখরুলের ঘন্টাব্যাপী সাক্ষাৎ বিশ্বের প্রতি যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে - হাবিবুল মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিবেদন অনুমান ও অপ্রমাণিত অভিযোগ নির্ভর- পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ইউরোপে ভারতীয় ৫২৭ পণ্যে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি উপাদন শনাক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে কড়াকড়ি বিএনপির আন্দোলন ঠেকানোই ক্ষমতাসীনদের প্রধান চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মাঠে ফেরাচ্ছে আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন নিয়ে অদৃশ্য চাপে বিএনপি


মেনন বললেন
`ভাসানীকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস মিথ্যা বয়ান'
বিশেষ প্রতিনিধি
  • আপডেট করা হয়েছে : ২৪-১১-২০২২
`ভাসানীকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার  ইতিহাস মিথ্যা বয়ান'


 বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পঞ্চাশ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানের এক আলোচনা সভায় পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলছেন, মওলানা ভাসানীকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে মিথ্যা বয়ান। তিনি বলেন, পূর্ববাংলায় গণঅভ্যুত্থানের এই প্রচণ্ডতায় পশ্চিমা শক্তিগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা এর সব দায় মওলানা ভাসানীর ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ‘রেড মওলানা’, ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে চিত্রিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে মওলানার বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াও-সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়।মওলানা ভাসানীর ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে এসব কথা উঠে আসে। দিবসটিতে সরকারি বা বেসরকারিভাবে তেমন লক্ষণীয় আয়োজন ছিন না তবে এদিনে বিভিন্ন দল ছোট ছোট আয়োজন করে। ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষ এক আয়োজন ছিল দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিলনায়তনে। এতেও উঠে আসে দরটির পক্ষ থেকে আক্ষেপ যে ভাসানী ও স্বাধীনতা দু’টি সমার্থক শব্দ হলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালায় তাঁর বিশেষ কোনো প্রকাশ দেখা যায়নি।

গত ১৭ নভেম্বর তার প্রয়াণ দিবসের সংবাদ জাতীয় পত্রিকাগুলোর ভিতরের পাতায় স্থান পায়। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাঁরভূমিকা কেবল প্রভাবকেরই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে নির্ণায়কেরও। ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত ‘মওলানা ভাসানী ৪৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মরণে ‘ভাসানী ও স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনায় মূলপত্রে রাশেদ খান মেনন বক্তব্য রাখেন।  রাশেদ খান মেননেন বক্তব্যটি দেশ পত্রিকায় তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। 

রাশেদ খান মেনন বলেন, যখন কেউ ভাবতেই পারেনি তখন ১৯৪৮-এ পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে মওলানা ভাসানী পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের সুনির্দিষ্ট রূপ তুলে ধরেছিলেন। সেটাই অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যুক্তফ্রন্টের একুশ দফায় আর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে সোহরাওয়ার্দী যখন সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিয়েছিলেন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে পায়ে দলে ছিলেন, মওলানা পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রকারী শাসকগোষ্ঠীকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন না পেলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ জানাতে দ্বিধা করবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। এজন্য তাকে দল ছাড়তে হয়েছিল, তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় সেক্রেটারি মুজিবের সাথে তাঁর বিচ্ছেদ হয়েছিল। আবার সেই মুজিব যখন পূর্ব পাকিস্তাানের স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা রূপরেখা তুলে ধরায় ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি’ তখন তিনিই ৬৮-এর ডিসেম্বরে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের অর্গল খুলে দিয়েছিলেন।১৬ ফেব্রুয়ারি পল্টনে আইয়ুবকে এই মর্মে হুঁশিয়ার করেছিলেন যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া না হয়, তাহলে বাস্তিল দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করে আনবেন। সেনা কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছিলেন। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেও মওলানা ভাসানী স্বাধীনতার স্বপ্নকে ছাড়েন নাই। মেনন বলেন, ভাসানী ও স্বাধীনতা দুটি সমার্থক শব্দ হলেও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানমালায় তাঁর বিশেষ কোনো প্রকাশ দেখা যায়নি। ১৭ নভেম্বর তার প্রয়াণ দিবসের সংবাদ জাতীয় পত্রিকাগুলোর ভিতরের পাতায় স্থান পায়। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা কেবল প্রভাবকেরই নয়, ক্ষেত্রবিশেষে নির্ণয়কেরও। তাকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার ইতিহাস লেখা হবে মিথ্যা বয়ান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভাসানীর যাত্রা শুরু সেই আটচল্লিশেই। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই মুসলিম লীগ বাদে দেশে কোন সংগঠিত রাজনৈতিক দল ছিল না। মওলানা ভাসানী তাঁর রাজনীতির বিচরণ কেন্দ্র আসাম থেকে সবে পূর্ব বাংলায় এসেছেন। রাজনীতিক নেতা হিসেবে পূর্ববাংলায় তার বিশেষ কোনো পরিচিতি ছিল না। তিনি ঢাকায় এসে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশিক পরিষদের অধিবেশনে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের যে দাবি তুলে ধরেন সেটাই ভিত্তিস্থাপন করেছিল স্বায়ত্তশাসন প্রসঙ্গে পূর্ববাংলার মানুষের সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়। কেবল প্রদেশিক পরিষদের অধিবেশনের ভিতরেই নয় অধিবেশনের বাইরেও তিনি তার ওই দাবি পূরণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন এবং তারই সভাপতিত্বে পূর্ববাংলার প্রথম বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয় এবং সেই দলের ম্যানিফেস্টোতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের তার উত্থাপিত দাবি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। ৫৪-এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় তার একুশ দফাতে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের এই দাবি সুনির্দিষ্ট আকারে তুলে ধরা হয়। 

একথা সবার জানা যে চুয়ান্নর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা মেনে নিতে পারে নাই। আর তাই তারা যুক্তফ্রন্টে ঐক্যকে ভাঙার জন্য প্রথম থেকেই চেষ্টা নেয়। এক্ষেত্রে তারা কলকাতা বিমানবন্দরে শেরেবাংলা ফজলুল হকের একটি মন্তব্যকে ধরে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরোধিতার অভিযোগ আনে। পূর্বপাকিস্তানকে তাদের তাবে রাখতে কেন্দ্রীয় শাসকরা নির্বাচিত সরকারকে ভেঙে দিয়ে ৯২ ক ধারায় দেশে যে গভর্নরের শাসন কায়েম করে সেই গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জার আক্রমণের লক্ষ্যই ছিল মওলানা ভাসানী। মওলানা ভাসানী ভিয়েনায় শান্তি সম্মেলনে যোগ দিয়ে যখন দেশে ফিরে আসছিলেন তখন গভর্নর ইস্কান্দার মীর্জা তাকে বিমানবন্দরে গুলি করে মারার প্রকাশ্য হুমকি দেয়।


মওলানা তাতে নিশ্চুপ হন নাই। কলকাতায় কিছুদিন যাত্রাবিরতি করে দেশে ফিরে মওলানা ভাসানী আবার পূর্ববাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হন। তবে এবার কেন্দ্রীয় শাসকরা ছাড়াও তার দল আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষনেতা প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে দেয়া হবে এই শর্তে সোহরাওয়ার্দী কেন্দ্রীয় শাসকদের ‘সংখ্যাসাম্য নীতি’ মেনে নেন। অর্থাৎ পূর্ববাংলার মানুষ জনসংখ্যার দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের চাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও রাষ্ট্র পরিচালনায় পাকিস্তানের দুই অংশকে একই পাল্লায় মাপার ব্যবস্থা হয়। এই লক্ষ্য পূরণে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (বর্তমানে পাকতুনিস্থান)কে এক ইউনিটে পরিণত করা হয়। অপরদিকে পূর্ব বাংলা হয়ে দাঁড়ায় পাকিস্তানে পূর্বাঞ্চল তথা পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গণপরিষদের ভাষণে এই সংখ্যা সাম্যনীতির বিরোধিতা করলেও তার রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বলয় থেকে বের হতে পারেননি। শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক স্বীকৃত ‘সংখ্যাসাম্য নীতি’ মওলানা ভাসানী মেনে নিতে রাজী হননি এবং সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করে কেন্দ্রে মাত্র ১১ জন সদস্য নিয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলেও ওই সংখ্যাসাম্য নীতির বিরুদ্ধে ভাসানী তার বিরোধিতায় অটল থাকেন।আর ভাসানীর এই মৌলবিরোধিতা আরো স্পষ্ট রূপ নেয় কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আসাসালামু আলাইকুম’ জানাবার তাৎপর্যময় ঘোষণায়। মওলানা ভাসানীর এই ঘোষণা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে বিশালভাবে প্রভাবিত করেছিল তার পরিচয় মেলে সেই সময় আওয়ামী লীগের মুখপত্র বলে পরিচিত ইত্তেফাকের রাজনৈতিক প্রতিবেদন ও মানিক মিঞার উপ-সম্পাদকীয়তে। তিনি মওলানার এই আহ্বানকে খন্ডন করতে তার কলম তুলে নেন। অন্যদিকে মওলানা ভাসানীর কাগমারী সম্মেলনের এই ঘোষণাকে অস্বীকার করতে শহীদ সোহরওয়ার্দী ঢাকাসহ পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন জনসভায় দাবি করে বসেন যে পূর্বপাকিস্তান ইতিমধ্যে ‘আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন’ পেয়ে গেছে।

এই ঘটনাবলির প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি নতুন রূপ নেয়। মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে মুখ্য করে যে আওয়ামী লীগ গড়ে তুলেছিলেন সেই আওয়ামী লীগ বিরোধিতায় লিপ্ত, তখন তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি আরেকটি প্রশ্ন এই বিভক্তিকে ত্বরান্বিত করেছিল সেটা হলো ‘স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ, যা সোহরাওয়ার্দী সঙ্গে তার কুখ্যাত ‘জিরো প্লাস জিরো ইক্যুয়াল টু জিরো’ থিয়োরিতে নাকচ করে দিয়েছিলেন। সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে পাকিস্তান আরো ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়েছিল ‘পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়েটো-সেন্টো জোটে। 

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির এই ভাঙাচোরা অবস্থা ও পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিটের বিরুদ্ধে সে ধরনের কোনো বিরোধিতা না থাকায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকরা যার প্রাধান্যে ইতিমধ্যে সামরিক বেসামরিক আমলারা চলে এসেছে তারা এবার পাকিস্তানের ‘গণতন্ত্রকেই’ আঘাত করে বসে। জারি হয় সামরিক শাসন।

পাকিস্তানের এই সেনাশাসন দীর্ঘদশ বছর ধরে প্রলম্বিত হলেও এই সেনাশাসনই পূর্ববাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ পাকিস্তানের জাতি সত্তাসমূহের লড়াইকে সামনে নিয়ে আসে। পূর্ব পকিস্তানের সামরিক শাসনবিরোধী ছাত্রআন্দোলন, এমনকি শিক্ষা আন্দোলন অচিরেই রূপ নেয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের জাতিগত নিপীড়ন বিরোধী নতুন চেতনার উন্মেষে। শুরু হয় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে স্বাতন্ত্র্যের লড়াই। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরোধিতার মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলা অঞ্চলের মানুষ জানিয়ে দেয় যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি তারা আর আস্থাবান নয়। হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ-খিস্টান নির্বিশেষে বাঙালি একটি একক জাতিসত্তা। মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান, সর্বজনীন ভোটাধিকার, রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এ সকল দাবির আন্দোলন এই অঞ্চলের মানুষকে ক্রমান্বয়ে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের তীব্রতা মানুষকে এক পাকিস্তানের মোহ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি রূপ নেয় আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে।

ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের ভাবনায় আওয়ামী লীগকে গুছিয়ে নিয়েছেন এবং ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের অরক্ষিত অবস্থা কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে জনমনে যে ক্ষোভের জন্ম দেয় তাকে ব্যবহার করে তার কুশলী রাজনৈতিক পদক্ষেপে ১৯৬৬-তে এসে জনগণের সামনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা ঐতিহাসিক ছয় দফায় আরেকবার তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর এই ছয়দফা মানুষের কাছে গ্রহণীয় নয় কেবল, এর মধ্য দিয়ে তারা স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় পৌঁছে যান। রাজনীতির মাঠে ছয়দফা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চললেও মানুষ একে একদফা অর্থাৎ পূর্ববাংলার স্বাধীনতার অনিবার্য রূপ হিসেবে ধরে নেয়।

মওলানা ভাসানী ও স্বাধীনতার কথা বলতে গিয়ে ওপরের প্রসঙ্গটি একটু বিস্তারিত করে বলা এই কারণে যে ছয়দফার পাশাপাশি মওলানা ভাসানী ও ন্যাপ চৌদ্দদফার একই ধরনের একটি কর্মসূচি হাজির করলেও তার পালে কোনো হাওয়া পায়নি। বরং ছয়দফাকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে জনআকাক্সক্ষাকে মাথায় না রেখে তত্ত্বের মধ্যে তার নেতিবাচক বিশ্লেষণ রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় মওলানা ভাসানী ও ন্যাপকে পিছনে ফেলে দেয়। যে স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবি ছিল মওলানা ভাসানীর তা কার্যত বেহাত হয়ে যায়।

কিন্তু মওলানা ভাসানী নেতৃত্বের প্রশ্নে লালায়িত ছিলেন না। তার সামনে ছিল পূর্ববাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য। তাই পাকিস্তানি সেনা শাসকরা ছয়দফাকে ধ্বংস করতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রাষ্ট্রভাঙার ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে আগরতলা মামলায় তার বিচার শুরু করে তখন এই মওলানা ভাসানীই আবার এগিয়ে আসেন এর বিরুদ্ধে নতুন করে আন্দোলন গড়ে তুলতে। ১৯৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমের জনসভা থেকে তিনি লাটভবন তথা, গভর্নর হাউস ঘেরাওয়ের মধ্য দিয়ে নতুন যে আন্দোলনের সূত্রপাত্র করেন, তাই পরবর্তীতে মওলানার আহ্বানে গ্রামাঞ্চলসমূহে হাট হরতালে ও অন্যদিকে ছাত্রদের ১১ দফায় তাকে এগিয়ে নিয়ে রূপ নেয় ১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানে।

১৯৬৯-এর এই গণঅভ্যুত্থানই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রিহার্সেল। এই সময় দেশের শ্রমিকরা ঘেরাও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে তাদের অস্তিত্বের জানান দেন। অপরদিকে গ্রামের কৃষকরা গরুচুরি, তহশিলদারী অত্যাচারসহ মৌলিক গণতন্ত্রী মেম্বার-চেয়ারম্যানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। গরুচোর ধরে গণআদালতের বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়। বিভিন্ন স্থানে তহশিল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। মেম্বার-ৎচেয়ারম্যানদের বাধ্য করে পদত্যাগ করতে। ছাত্রদের পাশাপাশি দেশব্যাপী এই শ্রমিক-কৃষকের উত্থানে মওলানা ভাসানী ছিলেন প্রেরণা। ইতোমধ্যে তিনি কৃষকের লালটুপি বাহিনী বানিয়েছেন।

পূর্ববাংলায় গণঅভ্যুত্থানের এই প্রচণ্ডতায় পশ্চিমা শক্তিগুলো আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা এর সব দায় মওলানা ভাসানীর ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ‘রেড মওলানা’, ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ বলে চিত্রিত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের পক্ষ থেকে মওলানার বিরুদ্ধে জ্বালাও-পোড়াও-সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ইতিহাস বর্ণনায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের বিষয় সেভাবে না এলেও যে কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণই বলবেন এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের রিহার্সেল। এই অভ্যুত্থানকালেই সেøাগান ওঠে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধর, পূর্ববাংলা স্বাধীন কর’ আর ‘জয় বাংলা’ এখানে যে ব্যক্তিটি এই অভ্যুত্থানের সূচিমুখ খুলে দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানী। তাকে স্বাধীনতার রূপকার বলবোনা তবে কাকে বলবো।

এই কথা আরো সুস্পষ্টভাবে বেরিয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধকালে। পাকিস্তানি সেনারা মওলানা ভাসানীর সন্তোষের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দিলে মওলানা ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভারত সরকার তাকে সর্বোচ্চ মেহমানদারি করেন। তবে উত্তর ভারতে তিনি স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারলেও পূর্ব ভারতে সেটা ছিল নিয়ন্ত্রিত। তার সাথে তার কোনো অনুসারীকেই দেখা করতে দেয়া হয়নি। এর মাঝে থেকেই মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব নেতৃত্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চিঠি লেখেন, টেলিগ্রাম পাঠান। তার সঙ্গী সাইফুল ইসলামের মাধ্যমে সংবাদ সম্মেলন করে মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সরকারের প্রতি সমর্থন জানানো। আর সেই সময় যখন প্রবাসী সরকারের মধ্য থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনা শাসকদের সাথে সমঝোতার উদ্যোগ প্রকাশ হয়ে পড়ে, তখন এই মওলানা ভাসানীর ওপরেই প্রবাসী সরকারকে ভরসা করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের ওই ক্রিটিক্যাল সময়ে তার সভাপতিত্বে প্রবাসী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের যে সভা হয় সেই সভা মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।


অপরদিকে তার অনুসারীদের কাছে তার নির্দেশ ছিল কেউ না এলেও একা হলেও মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে। আর সকল ষড়যন্ত্র বিদীর্ণ করে ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের যখন বিজয় অর্জিত হয়, তখন তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে একই নিঃশ্বাসে বলেছিলেন বাংলাদেশের মাটি থেকে দ্রুত ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করতে। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে দিল্লি হয়ে ঢাকা আসতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পরিপূর্ণতা দিতে দিল্লিতে প্রথম দেখাতেই ইন্দিরা গান্ধীকে একই অনুরোধ করেছিলেন। আর এই ঘটনাবলি এটাই প্রমাণ করে মওলানা ভাসানী তার সমস্ত জীবনের সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতার চেতনার যে ভিত্তি তৈরি করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর কুশলী হাতে সেটাই স্বাধীনতায় রূপ নিয়েছে। তাই ভাসানীকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতা নয়, ভাসানী আর স্বাধীনতা পরস্পরের পরিপূরক।



শেয়ার করুন